দৈনিক গৌড় বাংলা

বুধবার, ৯ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, সকাল ৭:২৩

নীলগিরি

নীলগিরি (Nilgiri) কে বলা হয় বাংলার দার্জিলিং। দীগন্ত জুড়ে সবুজ পাহাড় আর মেঘের লুকোচুরি যে কাউকে এর রূপ দিয়ে বিমোহিত করে রাখবে। যদি সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ২২০০ ফুট উচ্চতায় মেঘ ছোঁয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে নীলগিরি আপনার সেই ইচ্ছে পূরণ করবে। নীলগিরি পাহাড় চূড়াতেই রয়েছে সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটক কেন্দ্র গুলোর একটি নীলগিরি পর্যটক কেন্দ্র। বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ২২০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের নাম নীলগিরি।

নীলগিরি থেকে চারপাশে চোখ মেলে তাকালে সারি সারি মেঘের পাহাড়ে আছড়ে পড়া ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য আপনাকে বিমোহিত করবে। নীলগিরির চূড়া থেকে পাহাড়ের সারির পাশাপাশি আকাশ পরিস্কার থাকলে আপনার চোখে পড়বে বগালেক, বাংলাদেশের পঞ্চম সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়া কেওক্রাডং, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত এবং চট্টগ্রাম বন্দর ও সাঙ্গু নদী। এছাড়াও নীলগিরির কাছের আদিবাসী গ্রাম থেকে পরিচিত হতে পারেন তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে। নীলগিরিতে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকায় নিরাপত্তা নিয়ে কোন বিভ্রান্তির কারণ নেই তাই পরিবার নিয়ে অনায়াসেই ঘুরে আসতে পারেন বাংলার দার্জিলিং খ্যাত নীলগিরি। আপনার ঘুরে বেড়ানোকে সহজ ও আনন্দময় করে তোলার জন্যেই পড়ুন নীলগিরি নিয়ে সকল তথ্যের এই ভ্রমণ গাইড।

কখন যাবেন

নীলগিরি তার রূপের পসরা সারাবছরই মেলে ধরে রাখে। একেক সময়ে একেক রূপের আঁধার নীলগিরি। সকালে মেঘের ভেলার খেলা, সূর্যোদয়ের আলোর খেলা। বিকেলের সূর্যাস্ত কিংবা জ্যোৎস্না রাতের মায়াময় চারপাশ আপনাকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করবেই। সাধারণত বর্ষা, শরৎ ও হেমন্তে মেঘের ভেলার লুকোচুরি খেলা প্রত্যক্ষ করা যায় সুন্দর করে। আর এই জন্যে নীলগিরিতে খুব সকালে যেতে হবে। শরৎ আর হেমন্তের মেঘ আর নীল আকাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। শীতে কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকে চারপাশ। সে এক দেখার মত দৃশ্য। তাই নীলগিরি যেতে পারবেন যে কোন সময়ই। তবে বর্ষায় অতি বৃষ্টি হলে পাহাড় ধ্বসের আশংকা থাকে তখন অনেক সময় নীলগিরি যাবার রাস্তা বন্ধ থাকে।

নীলগিরি যাবার উপায়

দেশের যে প্রান্তেই থাকেন আপনাকে প্রথমে বান্দরবান আসতে হবে নীলগিরি যাবার জন্যে। ঢাকার আব্দুল্লাহপুর, আরামবাগ, কল্যাণপুর, গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে থেকে এস. আলম, সৌদিয়া, সেন্টমার্টিন পরিবহন, ইউনিক, হানিফ, শ্যামলি, ডলফিন ইত্যাদি পরিবহনের বাস বান্দারবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি এসব বাসের ভাড়া যথাক্রমে নন এসি ৮০০-৯০০ টাকা ও এসি ১২০০-১৮০০ টাকা। ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান যেতে সময় লাগে ৮-১০ ঘন্টা।

ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে পর্যটক এক্সপ্রেস, কক্সবাজার এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশিতা, মহানগর গোধূলি এইসব ট্রেনে করে চট্রগ্রাম যেতে পারবেন। শ্রেনীভেদে ভাড়া ৩৪৫ থেকে ১১৭৯ টাকা। এছাড়া ঢাকা থেকে আকাশ পথে সরাসরি চট্রগ্রাম আসতে পারবেন।

চট্টগ্রামের বদ্দারহাট থেকে পূবালী ও পূর্বানী নামের দুটি বাস বান্দারবানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এ দুটি বাসে জনপ্রতি ২২০ টাকা ভাড়া লাগে। চট্রগ্রামের দামপাড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে ২০০-৩০০ টাকা ভাড়ায় বাসে করে বান্দরবান আসতে পারবেন।

বান্দরবান থেকে নীলগিরি : বান্দরবান থেকে নীলগিরি যেতে পারবেন জীপ/চান্দের গাড়ি/মহেন্দ্র/সিএনজি অথবা লোকাল বাস দিয়ে। সবচেয়ে ভালো হয় রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে গেলে। এতে করে আপনি আশেপাশের আরও কিছু জায়গায় ঘুরে দেখতে পারবেন। যদি দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে চান তাহলে বান্দরবান জীপ স্টেশন থেকে বিভিন্ন গাড়ি অনুযায়ী ৩০০০-৫০০০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া আসা সহ গাড়ি ঠিক করে নিতে হবে। চাঁন্দের গাড়ী গুলোতে ১২-১৪ জন যেতে পারবেন, ল্যান্ডক্রুজার টাইপ জীপ গুলোতে ৭-৮ জন যেতে পারবেন, ছোট জীপ আছে সেগুলোতে ৪-৫ জন থেকে পারবেন আর সিএনজিতে ৩-৪ জন। রাস্তায় কোন সমস্যা না থাকলে যেতে সময় লাগবে দুই থেক সাড়ে দুই ঘন্টার মত। নীলগিরিতে যদি মেঘের দেখা পেতে চান তাহলে আপনাকে খুব ভোরে রওনা দিতে হবে যেন ৭-৮ টার ভিতর নীলগিরি থাকতে হবে।

সদস্য সংখ্যা কম হলে কিংবা কম খরচে যেতে চাইলে লোকাল বাসে যেতে পারেন, তবে এতে সময় লাগবে বেশি। থানচি বাস স্ট্যান্ড থেকে ১ ঘন্টা পর পর থানচির উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়, ভাড়া ১২০ টাকা। তবে আপনি চাইলে অন্য কোন গ্রুপ নীলগিরি যাবে তাদের সাথে যোগ হয়ে যেতে পারেন ভাড়া শেয়ার করে।

নীলগিরি যাওয়ার পথে নিরাপত্তার জনিত কারণে সেনা চেকপোষ্টে পর্যটকদের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হয়। সাধারণত বিকেল ৫ টার পর থেকে নীলগিরির উদ্দেশে আর কোন গাড়ীকে যেতে দেয়া হয় না তাই ভ্রমণের পূর্বে সময়ের দিকে খেয়াল রাখুন। নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে যাবার জন্যে পর্যটকদের কাছ থেকে টিকেট বাবদ জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং গাড়ির জন্য আলাদা ৩০০ পার্কিং ফি নেয়া হয়।

ভ্রমণ পরিকল্পনা

নীলগিরি যাবার পথেই মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্ট, শৈল প্রপাত ঝর্ণা, সাইরু হিল রিসোর্ট ও চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্র পার হয়ে যেতে হবে। রিজার্ভ গাড়ি নিলে এই স্পট গুলোতে নেমে কিছু সময় অতিবাহিত করতে পারবেন। গাড়ি ঠক করার সময় আগে থেকেই বলে রাখবেন। তবে সবচেয়ে ভালো হয় সকালে সরাসরি নীলগিরি চলে গেলে তাহলে মেঘের দেখা পাবেন। ফিরে আসার সময় চিম্বুক পাহাড়ে কিছু সময়, তারপর শৈলপ্রপাত ঝর্ণাতে কিছু সময় কাটিয়ে আসবেন। আর যাবার পথেই মিলনছড়ি ভিউ পয়েন্টে চেকপোস্টে নামতে হবে তখন সেখান থেকে চারপাশের সুন্দর দৃশ্য দেখে নিতে পারবেন। আবার উল্টোটাও করতে পারেন যদি প্ল্যান থাকে বিকেল বেলা নীলগিরিতে সময় কাটাবেন তাহলে যাবার পথেই শৈলপ্রপাত ঝর্ণা ও চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্রে কিছু সময় পার করে তারপর নীলগিরি যাবেন।

কোথায় থাকবেন

নীলগিরিতে বাংলাদেশ সেনবাহিনী নিয়ন্ত্রিত নীলগিরি রিসোর্টে রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে। ছয়টি কটেজে থাকার জন্য প্রতি রুমের ভাড়া পড়বে ৮,০০০ টাকা। নীলগিরি রিসোর্ট সবার কাছে আকর্ষনীয় হওয়ায় সাধারণত মাসখানেক আগে বুকিং না দিলে রুম পাওয়া যায় না, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে পূর্ব বুকিং ছাড়া রুম পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যোগাযোগ: 01769-299999

এছাড়া বেশীরভাগ পর্যটক বান্দরবান থেকে নীলগিরি দিনে গিয়ে দিনেই বান্দরবান ফিরে আসেন। বান্দরবানে থাকার জন্যে বেশ কিছু হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে। বান্দরবান শহর ও তার আশেপাশেই হোটেল ও রিসোর্ট গুলোর অবস্থান। বান্দরবান থাকার জন্যে যে সকল হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে তার মধ্যে:

হোটেল হিল ভিউ: বান্দরবান শহরের বাস স্ট্যান্ড এর পাশেই। ভাড়া ১০০০ থেকে ২৫০০ টাকা।
হোটেল হিলটন: বান্দরবান শহরের বাস স্ট্যান্ড এর কাছেই। ভাড়া ১২০০ থেকে ৩৫০০ টাকা।
হোটেল প্লাজা: বাস স্ট্যান্ড থেকে ৫মিনিট হাঁটা দূরত্বে। ভাড়া ৬০০ থেকে ৩০০০ টাকা।
রিভার ভিউ: শহরের সাঙ্গু নদীর তীর ঘেষে হোটেলটির অবস্থান। ভাড়া ৬০০ থেকে ২০০০ টাকা।
পর্যটন মোটেল: পাহাড় ও লেকের পাশেই অবস্থিত। শহর থেকে ৪ কি:মি: দুরে মেঘলায় অবস্থিত। ভাড়া ১২০০ থেকে ২৫০০ টাকা।

আমাদের ভিডিও গাইড : বান্দরবানের সেরা হোটেল রিসোর্ট

মনে রাখা ভালো কোন সময়ে যাচ্ছেন তার উপর ভাড়া নির্ভর করবে। সিজন (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারী) ও সরকারি ছুটির দিনে পর্যটকের সমাগম বেশি হয় বলে ভাড়া কম বেশি হতে পারে। আর আপনি সিজন ও ছুটির দিনে যান তাহলে ঝামেলা এড়াতে আগে থেকেই হোটেল রুম বুকিং করে রাখতে পারেন। অফসিজনে গেলে ২০-৫০% ডিসকাউন্ট থাকে। এছাড়া অসংখ্য রিসোর্ট, হোটেল, মোটল এবং রেস্টহাউজ রয়েছে যেগুলোতে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় সহজেই রাত্রিযাপন করতে পারবেন।

কোথায় খাবেন

নীলগিরিতে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে, খিদে পেলে পেট ভরে সেখান থেকে খেয়ে নিতে পারেন। তবে সেখানে খেতে হলে আগে থেকে অর্ডার করে রাখতে হবে, জনপ্রতি ৩০০-৬০০ টাকায় খেতে পারবেন। অথবা ফিরে এসে বান্দরবান শহরে খেয়ে নিতে হবে। যাবার সময় কিছু শুকনো খাবার সাথে নিয়ে নিতে পারেন। বান্দরবান শহরে খাওয়ার জন্যে রয়েছে বেশি কিছু রেস্তোরা, তার মধ্যে তাজিং ডং ক্যাফে, মেঘদূত ক্যাফে, ফুড প্লেস রেস্টুরেন্ট, রুপসী বাংলা রেস্টুরেন্ট, রী সং সং, কলাপাতা রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি।

নীলগিরি এর আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

  • চিম্বুক পাহাড়
  • সাইরু হিল রিসোর্ট
  • শৈল প্রপাত
  • মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র
  • নীলাচল
  • স্বর্ণমন্দির
  • বগালেক

নীলগিরি ভ্রমণ টিপস

  • গাড়ি ঠিক করার জন্যে সরাসরি জীপ স্ট্যান্ডে কথা বলবেন। প্রয়োজনে দরদাম করে নিবেন।
  • শৈল প্রপাত বা চিম্বুকে আদিবাসীদের তৈরি জিনিস পত্র কিনতে পারবেন কম দামে।
  • বান্দরবান থেকে নীলগিরি পুরো পথ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, ভ্রমণে সাবধান হোন।
  • চান্দের গাড়িতে ছাঁদে চড়বেন না।
  • শৈল প্রপাত ঝর্ণায় নামার সময় সাবধান থাকুক, পাথুরে পথ অনেক পিচ্ছিল।
  • আদীবাসিদের অসম্মান হয় এমন কিছু দয়া করে করবেন না।
  • যদি সম্ভব হয় নীলগিরিতে এক রাত থাকবেন, আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
  • অযথা কোন রিক্স নিতে যাবেন না।
  • সাথে করে জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি রাখুন সবসময়।
  • কম খরচে নীলগিরি ভ্রমণ করতে দলগত ভাবে ভ্রমণ করতে পারেন।

About The Author